top of page

কবি আল মাহমুদ সম্পর্কে, জন্মদিনে

রফিক সুলায়মান

ree

'আমরা পৃথিবীবাসী শুধু দেখি রক্ত আর ক্লেদ

বুঝি না মৃত্যুর ভাষা, সত্য আর মিথ্যার প্রভেদ।'


'কী নাম যেন ওই পাখিটার, সাঁঝের কোকিল?

ডাকছে একা বুকের ভেতর, স্তব্ধ নিখিল।'


'তুমি যদি খাও তবে আমাকেও দিও সেই ফল

জ্ঞানে ও অজ্ঞানে দোঁহে পরস্পর হব চিরচেনা।'


'প্রভাত ফেরী প্রভাত ফেরী নেবে আমায় সঙ্গে

বাংলা আমার বচন, আমি জন্মেছি এই বঙ্গে।'


‘পৃথিবীর সবেচেয়ে দামী ছিলো বুঝি আমাদের কয়েকটি কবির হৃদয়’


আল মাহমুদ বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আধুনিক কবি হিসেবে বিবেচিত হন একাধিক কারণে। তাঁর কবিতায় ভাষার শক্তি, চিন্তার গভীরতা, দেশজ অনুভব, সাংস্কৃতিক চেতনা এবং মানবিক বোধের সংমিশ্রণ তাঁকে একজন "বড় কবি" করে তুলেছে।

আল মাহমুদ বাংলা কবিতায় গ্রামীণ ও লোকজ শব্দ, উপমা এবং রূপক ব্যবহার করে এক নতুন ভাষার ধারা সৃষ্টি করেন। তিনি শহুরে কাব্যধারার বাইরে গিয়ে বাংলা কবিতাকে এক গভীর মাটির ঘ্রাণ দিয়েছেন। উদাহরণ : কবিতা তো মক্তবের মেয়ে,

চুল খোলা আয়েশা আক্তার। - এই ধরনের পঙক্তিতে আবহমান গ্রামবাংলার চিত্র ও লোকায়ত ঘ্রাণ পাওয়া যায়।

আল মাহমুদের কবিতায় সামাজিক ও রাজনৈতিক চেতনা স্পষ্ট। তিনি পূর্ববাংলার স্বাধিকার আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, এবং গণমানুষের বেদনা তাঁর কবিতায় স্থান দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাঁর কবিতা 'ক্যামোফ্লেজ' বাংলা সাহিত্যের স্থায়ী সম্পদ। 'বোশেখ' কবিতায় রবীন্দ্রনাথকে যেভাবে চিত্রিত করেছেন তা অনবদ্য। অন্য এক কবিতায় মুজিবকে নিয়ে লিখেছেন : 'সে যখন ডাকলো 'ভাইয়েরা আমার।' / ভেঙে যাওয়া পাখির ডাক নেমে এলো পৃথিবীর ডাঙায়।' ভাসানীকে এঁকেছেন অতিপ্রাকৃত উপমায় : 'মওলানার টুপিওয়ালা উঁচু মাথাটি যেন / এক হারিয়ে যাওয়া পর্বতের স্মৃতি।' তাঁর কবিতায় অন্য শতকের অগ্রজ কবি মুকুন্দরাম এবং আলাওলও ঠাঁই পেয়েছেন পরম ভালোবাসায়। অন্যত্র লিখেছেন : ‘পৃথিবীর সবেচেয়ে দামী ছিলো বুঝি আমাদের কয়েকটি কবির হৃদয়’ [অধ্যয়ন, লোক লোকান্তর]।

তাঁর শ্রেষ্ঠতম সাহিত্যকীর্তি ‘সোনালি কাবিন’, যেখানে প্রেম, সমাজ, ধর্ম ও বাস্তবতার দ্বন্দ্ব একসাথে উঠে এসেছে। তবে 'কালের কলস' এর একটি কবিতায় নারীর বেদনার্ত ছবিও এঁকেছেন কবি : 'আমিও যখন এসেছি নগরে এ কি! / তোমার শরীরে আভরণ নেই কোনো / পশুর থাবায় বিঁধে আছে চেয়ে দেখি / নাভিমূল আর কামনার অঙ্গনও।' [হে আচ্ছন্ন নগরী, কালের কলস]

তিনি লোক-বাংলা এবং ইসলামী ভাবধারাকে আধুনিক চেতনার সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছেন, যা খুব কম কবিই করতে পেরেছেন। এটি তাঁকে স্বতন্ত্র উচ্চতা দান করেছে। প্রান্তিক মানুষের হৃদয়ের আকুতি প্রকাশ করতে করতে একসময় তিনি হয়ে উঠেছেন গোটা দেশের কণ্ঠস্বর।

আল মাহমুদের কবিতা ছন্দ, শব্দের দ্যোতনা ও চিত্রকল্পের কারণে সংগীতধর্মী হয়ে ওঠে। তাঁর কবিতা শুধু পাঠে নয়, শ্রবণেও এক রকম আনন্দ দেয়। 'যদি যান কাউতলি রেলব্রিজ পেরিয়ে ভাদুঘর গ্রাম' কিংবা 'বিষাদগীতি গাইছে বসে তিতুমীরের কন্যা' - এ ধরনের লিরিক্যাল পঙক্তি তিনি অযুত বার সৃষ্টি করেছেন।

ছোটগল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধ লিখলেও তিনি প্রধানত একজন কবি। কবি শামসুর রাহমানকে একবার আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম : আল মাহমুদের কোন সৃষ্টি আপনার প্রায়শ পড়তে ইচ্ছে করে। - এক মুহূর্ত না ভেবে তিনি বলেছিলেন, 'প্রতিতুলনা। এটি অতিমানবীয় রচনা।'

আল মাহমুদ সন্দেহাতীতভাবে অনেক বড় কবি, কারণ তিনি বাংলা কবিতাকে একটি নতুন ভাষা, শৈলী ও দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েছেন। তাঁর কবিতা শুধু সাহিত্য নয়; ইতিহাস, সংস্কৃতি ও আত্মপরিচয়ের এক জীবন্ত দলিল। এভাবেই তিনি হয়ে উঠেছেন আমাদের অন্যতম সাংস্কৃতিক মানচিত্র। তাই আল মাহমুদকে পড়তে হয়, তা না হলে পিছিয়ে পড়তে হয়।

[বেঁচে থাকলে কবি আজ ৮৯ পূর্ণ করতেন। জন্মদিনে এই অধমের গভীর শ্রদ্ধা তাঁর স্মৃতি ও অবদানের প্রতি: রফিক সুলায়মান, শিল্প-সমালোচক ও কিউরেটর।]

Comments


পাঠক নিবন্ধন ফর্ম​

জমা দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ!

লেখা প্রদানের জন্য মেইল করুন

banglakotha2011@gmail.com

©2025 by Banglakotha

Bangladesh

bottom of page