top of page

স্মৃতি-বিস্মৃতির ২৯ শে এপ্রিল।। মোঃ জেহাদ উদ্দিন

Updated: May 6, 2021


ree

সারা বিশ্ব কোভিড-১৯ মহামারিজনিত এক মহাদুর্যোগের মধ্যে রয়েছে। যখন এ লেখাটি নিয়ে বসেছি, তখন পত্রিকার পাতায় চোখ বুলিয়ে দেখছি, বিবিসি’র একটি সংবাদ। আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল রেসকিউ কমিটি (আইআরসি) বলছে, বিশ্বের ১০০ কোটি লোক করোনায় আক্রান্ত হবে, মারা যেতে পারে ৩০ লাখেরও বেশি মানুষ।

আইআরসি’র শংকা মিথ্যা হোক তা আমরা মনে প্রাণে চাই। কিন্তু পরিস্থিতির তো কোন উন্নতি চোখে পড়ছে না। ঠিক এই মুহূর্তের হিসেবে (২৯ এপ্রিল ২০২০, ভোররাত ৩:৫৫) বিশ্বে কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা ৩১,০৬,৫৯৮ এবং মৃতের সংখ্যা ২,১৪,৬৪২। বাংলাদেশে আক্রান্ত ৬,৪৬২ এবং মৃত্যু ১৫৫। সংখ্যাগুলো দ্রুত বাড়ছে। কোথায় গিয়ে থামবে কেউ জানে না।

এরই মধ্যে স্মৃতির পাতায় উঁকি দিচ্ছে ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল। ভয়াল ২৯ এপ্রিল। ১৯৯১ সালের এই দিনে স্মরণকালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের মুখোমুখি হয়েছিল চট্টগ্রাম, সদ্বীপ প্রভৃতি এলাকা। সেই ঘূর্ণিঝড়ে দেড় লক্ষাধিক লোকের প্রাণহানি হয়েছিল। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তথা সর্বস্ব হারিয়েছিল এক কোটির বেশি মানুষ। আর্থিক ক্ষতি ছিল ১.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অধিক।

মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে ২২শে এপ্রিল, ১৯৯১ বঙ্গোপসাগরে একটি গভীর নিম্মচাপের সৃষ্টি হয়। বাতাসে গতিবেগের ও নিম্মচাপের আকার বৃদ্ধির সাথে সাথে এটি ২৪শে এপ্রিল 02B ঘুর্নিঝড়ে রূপ নেয়। ঘুর্নিঝড়টি উত্তর-পূর্বদিকে অগ্রসর হওয়ার সাথে সাথে এর শক্তি আরও বাড়তে থাকে। ২৮ ও ২৯ এপ্রিল এটির তীব্রতা প্রচন্ড বৃদ্ধি পায় এবং গতিবেগ ১৬০ মাইল/ঘণ্টায় পৌছায় যা একটি ক্যাটাগরী-৫ ঘূর্নিঝড়ের সমতুল্য। ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখানো হয়। বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় বিদ্যুৎ ও টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা। ২৯শে এপ্রিল রাতে এটি চট্টগ্রামের উপকূলবর্তি অঞ্চলে ১৫৫ মাইল/ঘণ্টা বেগে আঘাত করে যা ক্যাটাগরী-৪ ঘূর্ণিঝড়ের সমতুল্য। স্থলভাগে আক্রমণের পর এর গতিবেগ ধীরে ধীরে হ্রাস পায় এবং ৩০শে এপ্রিল এটি বিলুপ্ত হয়।

আমরা ছিলাম ১৯৯১ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থী। মে মাসের ২ তারিখ থেকে পরীক্ষা শুরু হবার কথা ছিল। সরকারের সমস্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন। আমরা পরীক্ষার্থীরাও মানসিকভাবে প্রস্তুত।

আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়া অন্নদা সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র। ক্লাসের ফার্স্ট বয়। শুধু তাই নয়। বিদ্যালয়ের সদ্য অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক সর্বজনশ্রদ্ধেয় কিংবদন্তিতুল্য নুরুল হুদা স্যারসহ বিদ্যালয়ের সম্মানিত সকল শিক্ষকের প্রত্যাশা আমি বোর্ডে ফার্স্ট স্ট্যান্ড করব। নুরুল হুদা স্যার তো ১৯৮৬ সালে আমি যখন ক্লাস সিক্সে ভর্তি হই, তখনই বলে দিয়েছিলেন আমি নাকি বোর্ডে ফার্স্ট হব। জানি না স্যার কোন জাদুবলে এক কথা বলেছিলেন। তবে স্যার যে আমার মনে স্বপ্ন বুনে দিয়েছিলেন তা আমি টের পেতাম। একজন প্রকৃত শিক্ষকের কাজই তো তা-ই।

২৯ এপ্রিল ১৯৯১ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আকাশে ভোররাত থেকেই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। সূর্যের দেখা নেই। রাস্তাঘাট কর্দমাক্ত হয়ে গেছে। এর মধ্যে প্রাত্যহিক কাজের প্রয়োজনে কেউ কেউ রাস্তায় বের হচ্ছে। আমাদের এসএসসি পরীক্ষার মাত্র দু’দিন বাকি। আমি বোর্ডিং এর মাঠের উত্তর-পশ্চিম কোণে অবস্থিত অন্নদা স্কুলের হোস্টেল থেকে বের হয়ে টেংকের পাড়ে বি-বাড়িয়া স্কুল মার্কেটে একটি সেলুনে গেলাম। চুল-টুল কাটিয়ে যথারীতি হোস্টেলে ফিলে এলাম। ততক্ষণে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতে আমি প্রায় ভিজে গেছি। সেইদিকে আমার ভ্রুক্ষেপ নেই। আমি ভাবছি পরীক্ষার কথা। হোস্টেলের মেঝেতে কাঁচকি মাছের ভাগার মতো দশটি পরীক্ষার দশভাগ বই খাতার দিকে আমি বারবার তাকাচ্ছি, আর ভাবছি, একদিন একটি পরীক্ষা দেব, আর সেই বই-খাতাগুলো বস্তায় ভরে ফেলব! আহা কি শান্তি!

২৯ এপ্রিল কখন সূর্যাস্ত হল তা আকাশ দেখে টের পেলাম না। আকাশের কান্না দেখে মনটাও কেমন যেন ভারি ভারি লাগছিল সারাটা দিন।

হোস্টেলে কোন টেলিভিশন ছিল না। আমাদের মধ্যে একজনের একটি রেডিও ছিল। মাগরিবের নামাজের পর রেডিওর খবর শুনতে গিয়ে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। সমুদ্র উত্তাল। চট্টগ্রাম উপকূলে রাতের বেলায় আঘাত হানতে পারে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়। বিপদ সংকেত হু হু করে বাড়ছে। ৪, ৬, ৮, ১০। মহাবিপদ সংকেত। মনটা কেঁপে কেঁপে ওঠছে। না জানি কি বিপদ ধেয়ে আসছে উপকূলে।

পড়ায় মন বসাতে পারছি না। চোখের পাতায় ভেসে ওঠছে কেবল উত্তাল সমুদ্র। কেমন আছে এখন সেখানকার মানুষগুলো। ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানলে কি উপায় হবে তাদের? আমার মতো কত হাজার হাজার পরীক্ষার্থীও রয়েছে সেখানে!

রেডিও তার সমস্ত অনুষ্ঠান বাতিল করে আবহাওয়ার বার্তা ঘোষণা করছে একের পর এক। সাথে ইসলামী নজরুল সঙ্গীত।

এক পর্যায়ে রেডিও সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। সেখানকার অবস্থা আর জানারও সুযোগ রইল না।

আমরা এশার নামাজ পড়ে কোন রকমে কিছু খেয়ে সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লাম।

পরদিন যে খবর আসতে লাগল তা অতি ভয়ংকর। ধ্বংস যজ্ঞে পরিণত হয়ে গেছে গোটা উপকূল। শুধু লাশ আর লাশ। শুধু আর্তনাদ আর আর্তনাদ।

পড়াশোনায় কি আর মন বসে? যেখানে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়ে গেল, যেখানে কোটি মানুষ সর্বস্ব হারিয়েছে, সেখানে আর কি ভাল থাকা যায়!

ছুটে যায় টিএ রোডে রেক্টোতে। এক টাকা পঁচিশ পয়সায় একটা পত্রিকা কিনে নিয়ে আসি। আর তাতে দেখি কেবল ধ্বংস আর ধ্বংসের ছবি।

এর মধ্যেই সরকার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিল, কুমিল্লা ও যশোর শিক্ষা বোর্ডের এসএসসি পরীক্ষা গ্রহণ করা সম্ভব ‍হচ্ছে না। অপর দু’টি শিক্ষা বোর্ড-ঢাকা ও রাজশাহী যথারীতি ২ মে থেকে পরীক্ষা নিয়ে নিল। আর আমরা পিছিয়ে গেলাম। আমাদের দৃষ্টিজুড়ে ২৯ এপ্রিলের অপূরণীয় ক্ষয়-ক্ষতির দৃশ্য।


(রচনা: ২৯ এপ্রিল ২০২০)

Comments


পাঠক নিবন্ধন ফর্ম​

জমা দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ!

লেখা প্রদানের জন্য মেইল করুন

banglakotha2011@gmail.com

©2025 by Banglakotha

Bangladesh

bottom of page