মহানবী (সাঃ) এর বিদায় হজ্জ্বের ভাষণ
- বাঙলাকথা
- Apr 11, 2021
- 4 min read
মহানবী (সাঃ) এর বিদায় হজ্জ্বের ভাষণ
-মোঃ জেহাদ উদ্দিন
দশম হিজরি/৬৩২ খ্রি.। বিদায় হজ্জের দ্বিতীয় দিনে আরাফাতের মাঠে অবস্থানকালে জাবাল-এ-রহমত টিলার শীর্ষে দাঁড়িয়ে উপস্থিত সমবেত মুসলমানদের উদ্দেশ্যে মহানবী (সাঃ এই ভাষণ প্রদান করেন যা পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণ।
হে মানবমণ্ডলী!
তোমরা মনোযোগ সহকারে আমার বক্তব্য শ্রবণ কর। আমি জানিনা, আগামী বছর এ সময়ে, এ স্থানে, এ নগরীতে তোমাদের সাথে আমার আর সাক্ষাৎ হবে কি-না।
হে মানবসকল!
সাবধান! সকল প্রকার জাহেলিয়াত, অজ্ঞতা ও কুসংস্কার আমি চিরতরে বিলীন করে যাচ্ছি। নিরাপরাধ মানুষের রক্তপাত চিরতরে হারাম ঘোষিত হল। প্রথমে আমি আমার বংশের পক্ষ থেকে রাবিয়া বিন হারেস বিন আবদুল মোত্তালিবের রক্তের দাবী প্রত্যাহার করে নিচ্ছি। সে বনি লাইস গোত্রে দুধ পান করায় হুযাইল তাকে হত্যা করেছিল।
হে মানবজাতি!
জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র থেকে ‘সুদ’ কে চিরদিনের জন্য হারাম ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হল। তোমাদের কেবল মূলধনের ওপর অধিকার রইল। তোমরা অন্যের ওপর অত্যাচার করবে না, নিজেরাও অত্যাচারিত হবে না। আমি আজ আমার চাচা আব্বাস ইবনে আবদুল মোত্তালিবের যাবতীয় সুদের দাবি প্রত্যাহার করে নিচ্ছি। অন্ধকার যুগের সব কৌলীন্য বিলুপ্ত করা হলো। দাসপ্রথা চিরতরে বিলুপ্ত করা হল।
হে লোকসকল!
বল আজ কোন দিন? সকলে বলল, ‘আজ মহান আরাফার দিন, আজ হজ্জের দিন’। সাবধান! তোমাদের একের জন্য অপরের রক্ত তার মাল সম্পদ, তার ইজ্জত-সম্মান আজকের দিনের মত, এই হারাম মাসের মত, এ সম্মানিত নগরীর মত পবিত্র আমানত। সাবধান! কারো কাছে যদি কোনো আমানত রক্ষিত থাকে, তাহলে সে যেন তা আমানতকারীর কাছে পৌঁছে দেয়।
হে মানবসকল!
নিশ্চয়ই তোমাদের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ একজন, তোমাদের সকলের পিতা হযরত আদম। তোমরা সবাই আদম থেকে আর আদমকে সৃষ্টি করা হয়েছে মাটি থেকে। আরবের ওপর অনারবের এবং অনারবের উপর আরবের কোন শ্রেষ্ঠত্ব নেই, সাদার উপর কালোর আর কালোর উপর সাদার কোন মর্যাদা নেই। মর্যদার একমাত্র মানদণ্ড হল ‘তাকওয়া’ বা আল্লাহ-ভীরুতা।
হে লোকসকল!
পুরুষদেরকে নারী জাতির উপর নেতৃত্বের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। তবে নারীদের বিষয়ে তোমরা আল্লাহ তা’য়ালাকে ভয় কর। নারীদের উপর যেমন পুরুষদের অধিকার রয়েছে, তেমনি পুরুষদের উপর রয়েছে নারীদের অধিকার। তোমরা তাদেরকে আল্লাহর জিম্মায় গ্রহণ করেছ। তাদের উপর তোমাদের অধিকার হচ্ছে তারা তাদের সতীত্বের হেফাজত করবে।যদি কোন নারী এ ব্যাপারে সীমালঙ্ঘন করে, তবে স্বামীদেরকে এ ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে যে, তারা স্ত্রীদেরকে বিছানা থেকে আলাদা করে দিবে এবং প্রয়োজনে হালকা শাস্তি দিবে; তবে কোনো অবস্থাতেই তাদের চেহারায় আঘাত করবে না। একজন স্ত্রীর তার স্বামীর নিকট থেকে উত্তম ভরণপোষণ পাবার অধিকার রয়েছে। তোমরা তাদেরকে উপদেশ দেবে ও তাদের সাথে সুন্দর আচরণ করবে।
হে উপস্থিতি!
মুমিনেরা পরষ্পর ভাই। আর তারা সকলে মিলে এক ও অখণ্ড মুসলিম ভ্রাতৃসমাজ। তোমরা এক ভাইয়ের ধন-সম্পদ তার অনুমতি ব্যতিরেকে ভক্ষণ করবে না। তোমরা একে অপরের উপর জুলুম করবে না।
হে মানুষেরা!
শয়তান আজ নিরাশ হয়ে পড়েছে। বড় বড় বিষয়ে সে তোমাদের পথভ্রষ্ট করতে সমর্থ হবে না, তবে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়ে তোমরা সর্তক থাকবে ও তার অনুসারী হবে না। তোমরা আল্লাহর ইবাদত করবে, দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত সালাত প্রতিষ্ঠা করবে, রমজান মাসের সিয়াম পালন করবে, যাকাত আদায় করবে ও তোমাদের নেতার আদেশ মেনে চলবে। তবেই তোমরা জান্নাত লাভ করবে। সাবধান! তোমাদের অধীনস্থদের বিষয়ে আল্লাহ তা’আলাকে ভয় কর। তোমরা যা খাবে তাদেরকে তা-ই খেতে দেবে। তোমরা যা পরবে তাদেরকেও সেভাবে পরতে দেবে।
হে লোকসকল!
আমি কি তোমাদের নিকট আল্লাহ তা’আলার পয়গাম ঠিকমতো পৌঁছে দিয়েছি?’ উপস্থিত সকলে বলল, ‘হ্যাঁ’। তারপর তিনি বললেন ‘আমার বিষয়ে আল্লাহ তা’য়ালা যেদিন তোমাদের জিজ্ঞাসা করবেন, সেদিন তোমরা কি সাক্ষ্য দিবে? সকলে একবাক্যে বলল, ‘আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি আমাদের নিকট রিসালাতের পয়গাম পৌঁছে দিয়েছেন, উম্মতকে সকল বিষয়ে উপদেশ দিয়েছেন, সমস্ত গোমরাহির আবরণ ছিন্ন করে দিয়েছেন এবং ওহীর আমানত পরিপূর্ণভাবে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব পালন করেছেন।’ এরপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) নিজ শাহাদাত অঙ্গুলি আকাশপানে তুলে তিনবার বললেন, ‘হে আল্লাহ তা’আলা! আপনি সাক্ষী থাকুন, আপনি সাক্ষী থাকুন, আপনি সাক্ষী থাকুন।’
হে মানুষেরা!
আল্লাহ তায়ালা তোমাদের সম্পদের মিরাস বা উত্তরাধিকার নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। এর চেয়ে কম- বেশি করবে না। সাবধান! সম্পদের তিন ভাগের এক অংশের চেয়ে অতিরিক্ত কোন অসিয়ত বৈধ নয়। সন্তান যার বিছনায় জন্ম গ্রহণ করবে, সে তারই হবে। ব্যভিচারের শাস্তি হচ্ছে প্রস্তরাঘাত। (অর্থাৎ সন্তানের জন্য শর্ত হলো তা বিবাহিত দম্পতির হতে হবে। ব্যভিচারীর সন্তানের অধিকার নেই)। যে সন্তান আপন পিতা ব্যতীত অন্যকে পিতা এবং যে কর্মচারি নিজের মালিক ব্যতীত অন্য কাউকে মালিক বলে গণ্য করে, তাদের উপর আল্লাহ তা’আলা, ফেরেশতাকুল এবং সমগ্র মানবজাতির অভিশাপ এবং তাদের কোন ফরয ও নফল ইবাদত কবুল হবে না।
হে কুরাইশ সম্প্রদায়ের লোকেরা!
তোমরা দুনিয়ার মানুষের বোঝা নিজেদের ঘাড়ে চাপিয়ে যেন কিয়ামতে আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ না কর। কেননা আমি আল্লাহর আযাবের মোকাবিলায় তোমাদের কোন উপকার করতে পারবো না। তোমাদের দেখেই লোকেরা আমল করে থাকবে। মনে রেখ! সকলকে একদিন আল্লাহ তা’আলার নিকট হাজির হতে হবে। সেদিন তিনি প্রতিটি কর্মের হিসাব গ্রহণ করবেন। তোমরা আমার পরে গোমরাহিতে লিপ্ত হবে না, পরস্পর হানাহানিতে মেতে উঠবে না। আমি সর্বশেষ নবী, আমার পরে আর কোন নবী আসবে না। আমার সাথে সাথে ওহির পরিসমাপ্তি হতে যাচ্ছে।
হে মানুষেরা!
আমি নিঃসন্দেহে একজন মানুষ। আমাকেও আল্লাহ তায়ালার ডাকে সাড়া দিয়ে চলে যেতে হবে। আমি তোমাদের জন্য দুটি বস্তু রেখে যাচ্ছি। যতদিন তোমরা এই দুটি বস্তু আঁকড়ে থাকবে, ততদিন তোমরা নিঃসন্দেহে পথভ্রষ্ট হবে না। একটি আল্লাহর কিতাব ও অপরটি রাসূলের সুন্নাহ।
হে মানবমণ্ডলী!
তোমরা আমির বা নেতার আনুগত্য করো এবং তার কথা শ্রবণ করো যদিও তিনি হন হাবশি ক্রীতদাস। যতদিন পর্যন্ত তিনি আল্লাহর কিতাব অনুসারে তোমাদের পরিচালিত করেন, ততদিন অবশ্যই তাঁর কথা শুনবে, তাঁর নির্দেশ মানবে ও তাঁর প্রতি আনুগত্য করবে। আর যখন তিনি আল্লাহর কিতাবের বিপরীতে অবস্থান গ্রহণ করবেন, তখন থেকে তার কথাও শুনবেনা এবং তার আনুগত্যও করা যাবে না। সাবধান! তোমরা দ্বীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি থেকে বিরত থাকবে। জেনে রেখো, তোমাদের পূর্ববর্তীগণ এই বাড়াবাড়ির কারণেই ধ্বংস হয়ে গেছে। (এ নির্দেশনাটি হচ্ছে অমুসলিমদের ক্ষেত্রে। অর্থাৎ কোন বিধর্মীকে বাড়াবাড়ি বা জোরজবস্তি করে ইসলামে দীক্ষা দেওয়া যাবে না। তবে একজন মুসলমানকে অবশ্যই পরিপূর্ণ ইসলামী জিন্দেগী অবলম্বন করে জীবনযাপন করতে হবে। এক্ষেত্রে সুবিধাবাদের কোন সুযোগ নেই)। নবীজি আবার বললেন, আমি কি তোমাদের নিকট আল্লাহর দ্বীন পৌঁছে দিয়েছি? সকলে বলল, ‘নিশ্চয়ই’।
হে উপস্থিতগণ!
অনুপস্থিতদের নিকট আমার এ বাণী পৌঁছে দেবে। হয়তো তাদের মধ্যে কেউ এ নসিহতের উপর তোমাদের চেয়ে বেশি গুরুত্বের সাথে আমল করবে। আসসালামু আলাইকুম-তোমাদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক। বিদায়। (সহীহ মুসলিম শরীফ)
Comments